সব শেষ

সব শেষ
ছবি: সংগৃহীত

‘কত সাজানো সংসার ছিল আমার। হাসি-খুশির সংসার। একটা দুর্ঘটনায় সব শেষ। আমার কলিজার দুই হাসান-হোসেন কই, তাদের ছেড়ে আমি কিভাবে থাকব। হাসপাতালে আমার জান্নাতের বাগানের টুকরা মেয়েটা আর বউটা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। কী হবে আমার। যাদের সুখের জন্য গ্রাম ছেড়ে ঢাকাতে কাজ করি; তারাই আজ নেই। সব শেষ রে আল্লাহ...।’

দুই সন্তান হারিয়ে এভাবেই আর্তনাদ করেন যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার যাদবপুর গ্রামের বাসিন্দা হেলাল মুন্সী। 

শুক্রবার যশোরের লেবুতলা এলাকায় বাসচাপায় তছনছ হয়ে গেছে তার পৃথিবী। স্ত্রী ও বড় মেয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। আরও হারিয়েছেন শাশুড়ি, খালা শাশুড়ি ও শ্যালিকাকে। একই পরিবারের পাঁচজনকে হারিয়ে শোকে পাথর হেলাল মুন্সী। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই কারো। এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের তেঁতুলতলা বাজারে বাসচাপায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে তিন শিশু ও নারীসহ সাতজন। তাদের মধ্যে যাদবপুরের একই পরিবারের পাঁচ স্বজন রয়েছেন। আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন দুইজন। শনিবার নিহত সাতজনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। 

বাঘারপাড়া উপজেলার যাদবপুরে ঈদগাহে তিনজন, সেকেন্দারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দুইজন আর মথুরাপুর গ্রামে একজন এবং সদর উপজেলার সুলতানপুরে একজনের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়। একসঙ্গে এতগুলো প্রাণ ঝরে যাওয়ায় গোটা এলাকা শোকে স্তব্ধ। 

নিহতরা হলেন- যাদবপুর গ্রামের হেলাল মুন্সীর দুই যমজ ছেলে হাসান ও হোসাইন (২), তার শাশুড়ি মাহিমা (৪৩), খালা শাশুড়ি রাহিমা খাতুন ও তার মেয়ে জেবা (৮), মথুরাপুর গ্রামের ওবায়দুর রহমানের ছেলে ইজিবাইক চালক মুসা (২৭), সদর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে ইমরান হোসেন (২৬)। এ সময় হেলাল মুন্সীর স্ত্রী সোনিয়া ও তার মেয়ে খাদিজা গুরুতর আহত হন। আহতদের যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তির পর অবস্থার অবনতি হলে সোনিয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এদের মধ্যে হাসান, হোসাইন, মাহিমা, রাহিমা ও ফাহিমা একই পরিবারের স্বজন। 

শুক্রবার মধ্যরাতেই বাড়িতে পৌঁছায় হেলালের যমজ দুই ছেলে ও শাশুড়ির লাশ।  এরপর খালা শাশুড়ি ও তার মেয়ে জেবার লাশ পাঠানো হয় পার্শ্ববর্তী গ্রাম মথুরাপুরে। হেলাল মুন্সী ঢাকাতে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন। ঘটনার দিন সকালে তিনি ঢাকাতে চলে যান। ঢাকাতে পৌঁছার কিছুক্ষণ পরেই শুনেন দুর্ঘটনার কথা। দুই সন্তানসহ নিকটাত্মীয়ের হঠাৎ চলে যাওয়া তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন স্ত্রী ও বড় মেয়ে। পরিবারের করুণ পরিণতিতে নির্বাক হয়ে গেছেন তিনি। শোকে বাকরুদ্ধ স্বজনরা। আহাজারিতে ভারি হয়ে গেছে যশোরের চারটি গ্রামের বাতাস। পরিবারের সদস্যদের কারও মুখে কথা নেই, সবাই যেন পাথর হয়ে গেছেন। 

শনিবার সকালে বাঘারপাড়ার যাদবপুরে নিহতদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, শোকস্তব্ধ গোটা এলাকা। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সান্ত্বনা দিতে এসে অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। 

আহত সোনিয়ার চাচা ছোটন হোসেন বলেন, খাদিজার গলায় টনসিলের সমস্যা ছিল। এটি অপারেশনের জন্য শুক্রবার বিকালে তারা বাড়ি থেকে ইজিবাইকে যশোরের একটি ক্লিনিকে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে লেবুতলা এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া একটি বাস তাদের চাপা দিয়ে কিছু দূর সামনে নিয়ে যায়। এতে আমাদের পরিবারের পাঁচজন মারা যান। এছাড়া আমার ভাতিজি সোনিয়া ও তার মেয়ে খাদিজা গুরুতর আহত হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল রাতেই সোনিয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খাদিজা যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

অপরদিকে একই উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের সেকেন্দারপুর গ্রামে প্রবাসী সাইদুল ইসলামের বাড়িতেও একই অবস্থা দেখা যায়। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কান্নার রোলে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

সাইদুল ইসলামের বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাহিমা বেগম মুক্তা ও তার মেয়ে জেবা তাহিরা স্বজনদের সঙ্গে যশোরে ক্লিনিকে যাওয়ার পথে মারা যান। তার ভাই সাইদুল ইসলাম মালয়েশিয়া প্রবাসী। মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ তিনি দেশে এসেছিলেন। সাইদুলের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে সুমাইয়া শিরিন ষষ্ঠ শ্রেণিতে, মেজো মেয়ে রিফা তামান্না পঞ্চম শ্রেণিতে এবং জেবা তাহিরা এ বছর স্কুলে ভর্তি হয়। 

বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিন্টু বলেন, ‘এই ইউনিয়নে এমন হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা এর আগে কখনো দেখেনি। একই পরিবারে পাঁচজনসহ সাতজন মারা যাওয়াতে ইউনিয়নজুড়েই শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আসলেই প্রতিদিনই ছোট বড় দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত ড্রাইভাররা হলেও আইনের ফাঁকে তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। আশা করি এ ঘটনায় জড়িত ড্রাইভারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।’

তিনি আরও বলেন, ‘নিহত ও আহতদের সবধরনের সহযোগিতা আশ্বাস দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। একই সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যত সহযোগিতা দরকার সেটা করা হবে।’

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন বলেন, লেবুতলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ইজিবাইক চালকসহ সাতজন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একই পরিবারের পাঁচজন রয়েছেন। বাস ও ইজিবাইকটি জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি এবং কাউকে আটকও করা যায়নি।

জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান জানান, নিহতদের দাফন ও আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা হবে। একইসঙ্গে তিনি নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন।