নিঃসন্তান দম্পতি এখন শত শত শিশুর মা-বাবা

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ও সভ্যতা ছড়িয়ে যাচ্ছেন তারা। তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামের অভাবী, ঝরে পড়া শিশুরা। এইসব শিশুদেরকে ঘিরেই তাদের যত স্বপ্ন।
কোমলমতি শিশুদের মুখের হাসির মাঝেই তারা খুঁজে পান যত সুখ। প্রতিটি শিশুই যেন তাদের সন্তান। তাদের নিজেদের নেই কোনো সন্তান, তবুও তারা এখন শত শত শিশুর মা-বাবা। এলাকার গরিব-অসহায় সব শিশুরাই যেন তাদের সন্তান।
বলা হচ্ছে মাগুরা সদর উপজেলার বগুড়া গ্রামের নিঃসন্তান শিক্ষক দম্পতি নওশের আলম ও মাহমুদা আলমের কথা।
নিজেদের সন্তান না থাকার অপূর্ণতাকে পেছনে ফেলে গ্রামের পৈতৃক ৪৪ শতক জমিতে ‘বগুড়া আ দর্শ শিশু বিকাশ কিন্ডারগার্টেন’ নামের একটি স্কুল গড়ে তোলেন তারা। নিজেদের খরচে স্কুল ঘর তৈরি করে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত দরিদ্র পরিবারের শিশুদের দুই যুগ ধরে বিনা বেতনে লেখাপড়া করাচ্ছেন এই নিঃসন্তান দম্পতি।
১৯৯৮ সালে ১২ শিক্ষার্থী নিয়ে বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এ সংখ্যা এখন প্রায় ১০০ জন। এসব শিক্ষার্থীরা সবাই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। অন্যের সন্তানকেই নিজেদের সন্তান মনে করে শিক্ষা দিয়ে চলেছে নওশের-মাহমুদা দম্পতি। তাদের এ অসামান্য অবদানে অনুপ্রাণিত হয়ে এ মহৎ উদ্যোগে স্বেচ্ছায় সঙ্গী হয়েছেন স্থানীয় আরো কয়েকজন শিক্ষক। এসব শিক্ষকও কোনো ধরনের বেতন ছাড়াই এলাকার শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখছেন।
নওশের আলম পার্শ্ববর্তী ফুলবাড়ি হাইস্কুলের সাবেক সহকারি প্রধান শিক্ষক। ১৯৮২ সালে তিনি যশোরের ঘোপ এলাকার মাহমুদা খাতুনকে বিয়ে করেন। তাদের নিজেদের কোনো সন্তান না থাকায় তারা নিজেদের সন্তানের জন্য অকৃত্রিম স্নেহ প্রদর্শনের সুযোগ পাননি; তবুও গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
নওশের আলম ও মাহমুদা দম্পতি শুধু এলাকার শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখছেন না, দরিদ্র পথচারীদের থাকার জন্য তিনি স্কুলের পাশে একটি ঘরও নির্মাণ করেছেন। যেখানে তাদের রাত যাপনের পাশাপাশি ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া এলাকার দরিদ্র ও এতিম কন্যা সন্তানদের বাড়িতে রেখে নিজ সন্তানের মর্যাদায় বড় করে বিয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন। এ ধরনের একাধিক এতিমকে তারা বিয়ে দিয়েছেন। যারা এখন মেয়ে-জামাই পরিচয়ে বিভিন্ন পার্বণে নিয়মিত তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করে।
বগুড়া আদর্শ শিশু বিকাশ কিন্ডারগার্টেনের নির্বাহী পরিচালক মাহমুদা আলম বলেন, অভাবী, ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষা দিয়ে প্রকৃত মানুষ তৈরি করার মাধ্যমে নিজেদের শত শত শিশুর মা-বাবা হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এক সময় সন্তান না হওয়ার কারণে কষ্ট পেতাম। কিন্তু এ স্কুলের মাধ্যমে আমরা এখন শত শিশুর মা-বাবা হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। জন্মদান কিংবা গর্ভধারণ ছাড়াই মা-বাবা হওয়া যায়। আপন সন্তানের মতো লালন-পালন করে কাটিয়ে দেওয়া যায় জীবন। নওশের-মাহমুদা দম্পতির ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুই এ স্কুলটিকে ঘিরে। যে কারণে উপার্জনের সবটুকুই ব্যয় করেন স্কুলটির পেছনে।
ফুলবাড়ি হাইস্কুলের সাবেক সহকারি প্রধান শিক্ষক নওশের আলম বলেন, আমাদের বয়স হয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা থাকব না। আমাদের স্কুলটি যেন টিকে থাকে। নিজেদের সাধ্যমতো টিনের ছাউনি আর টিনের বেড়ার মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। ইটের তৈরি কোনো দালান করা আমাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। তবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অবকাঠামোগত উন্নয়নে এগিয়ে এলে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।
-এইচপি