দুই শিশুর মা-বাবা তিনিই!

তালাবদ্ধ ঘরের বিছানায় খেলা করছে অবুঝ দুই ভাই-বোন। এর মধ্যে মরিয়মের বয়স সাড়ে তিন বছর আর তার ভাই নূরের বয়স মাত্র ১৮ মাস। দুজনের মুখে এখনো স্পষ্ট কথা ফোটেনি। এমনকি প্রসাব-পায়খানা করে নোংরার মাঝেই বসে থাকতে হয় তাদের। অবুঝ ওই দুই শিশুর বাবা ফিরোজ সিকদার রনি পেশায় একজন রিকশাচালক। তিনিই ওই দুই শিশুর একাধারে মা ও বাবা। কারণ শিশু দুটির মা বেঁচে নেই।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম কাউনিয়া হাজেরা খাতুন স্কুল সড়কের মোহাম্মদিয়া মসজিদ সংলগ্ন একটি ভাড়া বাসার এক কক্ষে এমন মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছে মা হারা অবুঝ ওই দুই শিশু।
বাসা ভাড়া ও শিশুদের মুখে আহার তুলে দেওয়ার জন্য অবুঝ দুই সন্তানকে ঘরে তালাবদ্ধ করে প্রতিদিন রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যান বাবা ফিরোজ। কারণ ওই দুই শিশুকে দেখার আর কেউ নেই। তবে সারাদিন পর তালা খুলে বাবা ঘরে ঢুকতেই হাসির ঝলক বয়ে যায় শিশু মরিয়ম ও নূরের মুখে। এভাবেই ফিরোজ তার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে পিতৃত্বের চরম পরীক্ষা দিয়ে চলেছেন প্রতিটি মুহূর্তে।
রিকশাও ঠিকমতো চালাতে পারি না। সব সময় মনটা পড়ে থাকে সন্তানদের কাছে। তারপরেও পেটের দায়ে নিরুপায় হয়ে ওদের তালাবদ্ধ ঘরে রেখে যেতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বিনা দোষে কারাভোগ করেছি। আমি বুঝি জীবনে কষ্ট কাকে বলে। ওরা আমার সন্তান। আমার গর্ভধারীনি মা আমাকে ছোট রেখে মারা গেছেন। আমি বুঝি মা ছাড়া সন্তানের কি কষ্ট। ওদের (শিশু) মা মারজান বেগমের মৃত্যুর পর এখনো বিয়ে করিনি, কারণ নতুন বউ এসে যদি আমার সন্তানদের তাড়িয়ে দেয় সেই ভয়ে। স্ত্রীকে হারিয়েছি কিন্তু সন্তানদের হারাতে চাই না।
ফিরোজ বলেন, আমি আমার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু কি যে হলো ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর আমার স্ত্রী মারজান আত্মহত্যা করলো।
জানা যায়, ফিরোজ ঝালকাঠির কিস্তাকাঠি গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নান সিকদারের ছেলে। প্রায় ১৫ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে তিনি বরিশালে এসেছেন। ২০১৯ সালে আগৈলঝাড়া উপজেলার বাসিন্দা মারজানকে বিয়ে করেন। রিকশা চালিয়েই সংসার চলতো তাদের।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে ফিরোজের স্ত্রী তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে যান। ৩০ ডিসেম্বর ভোররাতে শ্বাশুড়ি তাকে ফোন দিয়ে মারজানের অসুস্থাতার কথা বলে আগৈলঝাড়ায় যেতে বলেন। এরপর গিয়ে দেখেন তার স্ত্রীর ঝুলন্ত লাশ। কোনো কিছু বোঝার আগেই তারা তাকে বেঁধে মারধর করে পুলিশে সোর্পদ করে। পরে তার বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচণার মামলা হয়। ওই মামলায় চারমাস ১৮ দিন কারাগারেও ছিলেন তিনি। পরে আত্মহত্যা প্ররোচণার প্রমাণ না পাওয়ায় আদালতের বিচারক মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন।
এরপর ফিরোজ সন্তানদের নিজের কাছে নিয়ে এসে পশ্চিম কাউনিয়ার পুরানো ভাড়া বাসায় উঠেন। স্ত্রী আত্মহত্যার কারণ আজও জানেন না ফিরোজ। এমনকি স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে তার বাবার বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ির কেউ কোনো যোগাযোগ রাখেননি। তাই বলে জীবনের কাছে হেরে যেতে চান না ফিরোজ।
আক্ষেপ করে ফিরোজ সিকদার বলেন, যদি কেউ আমাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতেন বা কেউ একটা দোকানের ব্যবস্থা করে দিতেন, তাহলে সন্তানদের সবসময় পাশে রেখে দেখাশুনা করতে পারতাম। এতে অবুঝ ওই দুই শিশুকে আর তালাবদ্ধ ঘরে রাখার প্রয়োজন হত না।
সমাজসেবা অধিদফতরের বরিশাল জেলার প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, এতদিন বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখব। এছাড়া শিশু সুরক্ষা আইন অনুসারে যা যা করার দরকার সাধ্যমতো তাই করা হবে।
লালমোহননিউজ/ -এইচপি