এখন কেবলই স্মৃতি ছোট্ট মুনতাহা
মায়াবী চোখজোড়া অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাথায় চিকচিকে কালো চুল। মুখে একরাশ হাসি। ঠোঁটে দেওয়া লাল রঙের লিপস্টিক। কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ফুটফুটে শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনের একটি ছবি। মুনতাহার হাসিমাখা মুখের এই ছবিটি এখন কেবলই স্মৃতি। রোববার (১০ নভেম্বর) ভোরে লাশ উদ্ধারের ঘটনা জানাজানির পর মুনতাহার পরিবার তো বটেই, ফেসবুকজুড়েও মাতম চলছে। তার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার দিয়ে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি চেয়েছেন মানুষ।
কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তার ফুটফুটে একটি ছবি। শিশুটির হাসিমাখা মুখের ছবি যার দৃষ্টিতে পড়েছে তাকেই থমকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতে হয়েছে। এরই মধ্যে শিশুটির জন্য মানুষের মনে বিপুল আকুতি জমে ওঠে। মুনতাহাকে জীবিত খুঁজে পেতে তার জন্য মানুষ প্রার্থনা করেছে। কেউ কেউ ঘোষণা করেছে পুরস্কার। কিন্তু সবার আকুতি মিথ্যে করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় মুনতাহার নিথর দেহ। শিশু মুনতাহাকে হত্যা করেছেন তার সাবেক গৃহশিক্ষিকা মার্জিয়া আক্তার। আর এই হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেন তার মা। রোববার ভোরে শিশুটি মরদেহ মার্জিয়ার মা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন।
নিহত শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিন উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরদল গ্রামের ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে।
এদিকে এ ঘটনায় শিশু মুনতাহার গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম মার্জিয়া, তার মা আলিফজান বিবি ও নানি কুতুবজান বিবিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া আরো সন্দেহভাজন তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আটক করা হয়েছে। এ নিয়ে মোট ছয়জনকে আইনের আওতায় আনা হলো। নিহত মুনতাহা কানাইঘাট সদরের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে।
জানা যায়, গত ৩ নভেম্বর সকালে বাবার সঙ্গে স্থানীয় একটি ওয়াজ মাহফিলে গিয়েছিল মুনতাহা। সেখান থেকে ফিরে প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে খেলতে যায়। এরপর আর তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে ওই দিন কোনো একসময় মুনতাহাকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে বাড়ির পাশের ডোবায় পুঁতে রাখা হয়েছিল। পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
শিশু মুনতাহার করুন এই পরিণতি কেউ মেনে নিতে পারছেন না। মেয়ের লাশ দেখার পর থেকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা রামিমা বেগম। নির্বাক পাথরের মূর্তি হয়ে আছেন তিনি। মুনতাহার বাবা শামীম আহমদও পাগলপ্রায়। কথা বলার চেষ্টা করেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী নীরবে চোখের জল ফেলছে। স্বজনদের একটাই প্রশ্ন, ‘ফুলের মতো শিশুটিকে কেন এমন নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হতে হলো? কী দোষ করেছে শিশু মুনতাহা!’
মেয়ের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ। নিজেকে হতভাগা জন্মদাতা আখ্যা দিয়ে বলেন, আমার ফুলের মতো বাচ্চাটাকে কেন এভাবে হত্যা করা হলো! এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
তিনি বলেন, নিখোঁজের পর থেকে আমার মেয়েটা সারাদেশের মানুষের সন্তান হয়ে গেছে। নিখোঁজের পর দেশবাসী যেভাবে তার সন্ধানে এগিয়ে এসেছে, সহযোগিতা করেছে, ভালোবেসেছে, তাতে আমার মনে হয়েছে মুনতাহা সবার সন্তান। আমি হতভাগা জন্মদাতা।
মুনতাহার ফুফু ফাতেমা জান্নাত বলেন, কেন আমার ভাতিজিকে হত্যা করা হলো? মর্জিনা তো বাসায় এসে মুনতাহাকে পড়াত। তাকে ঘুরতে নিয়ে যেত। সে কিভাবে এ কাজ করল! পূর্ব শত্রুতা ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে রকম কিছু ছিল না। পড়ানো শেষে প্রায়ই মর্জিনা কাউকে না জানিয়ে মুনতাহাকে নিয়ে বেড়াতে চলে যেত। বারবার নিষেধ করেও কাজ হয়নি। পরে মুনতাহার বাবা তাকে গৃহশিক্ষকের কাজ থেকে বাদ দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সে এ কাজ করল কি না বুঝতে পারছি না!’ জানা গেছে, মর্জিনা স্থানীয় মাদরাসায় নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে।
পুলিশ ও মুনতাহার প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩ নভেম্বর মুনতাহাকে অপহরণের পর ওই দিন মাগরিবের পর মুনতাহাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এরপর রাতে তাকে বাড়ির পাশের একটি ডোবায় পুঁতে রাখা হয়। প্রতিবেশী মর্জিনার কথাবার্তায় সন্দেহ দেখা দিলে গত শনিবার রাতে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। ঘটনা জানাজানি হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে মর্জিনার মা অলিফজান রাত ৪টার দিকে ডোবা থেকে মুনতাহার লাশ তুলে পাশের পুকুরে ফেলে দিতে যাচ্ছিল। এ সময় স্থানীয়রা সেটি দেখে তাকে আটকে পুলিশে খবর দেয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ জনতা আলিফজানের ঘরে আগুন দেয়। পরে পুলিশ এসে তাদের নিবৃত্ত করে।
পুলিশ জানায়, লাশ উদ্ধারের সময় শিশু মুনতাহার শরীর কাদায় লেপ্টে ছিল। গলায় রশি জাতীয় কিছু পেঁচানো ছিল।
কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আউয়াল বলেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে এক মহিলা মুনতাহার বাড়ির পাশের একটি ডোবা থেকে মরদেহ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সম্ভবত পুকুরে ফেলে দেওয়ার জন্য মরদেহটি তোলা হয়েছিল। তখন স্থানীয় লোকজন বিষয়টি দেখে ফেলে। তিনি বলেন, আমরা আগে থেকে এলাকার কিছু মানুষকে বলে রেখেছিলাম পাহারা দেওয়ার জন্য। সে অনুযায়ী লোকজন পাহারায় ছিল। জড়িত থাকা সন্দেহে চারজনকে আটক করেছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান : ঠিক কী কারণে শিশু মুনতাহাকে হত্যা করা হয়েছে তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় এই হত্যাকাণ্ড কি না সেই প্রশ্ন বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে। নিহত মুনতাহার পরিবারও এর বাইরে কোনো বিরোধের কথা মনে করতে পারছে না। একাধিক
সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস), রফিকুল ইসলাম বলেন, তুচ্ছ কারণেই এই হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে। আমরা অভিযুক্ত মর্জিনা ও তার মাকে আটক করেছি। সঙ্গে আরো দুজনকে আটক করেছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। হয়তো সোমবার সকালের মধ্যে হত্যার রহস্য জানানো যাবে।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, সিলেট জেলা পুলিশ প্রথম থেকে বাচ্চাটিকে উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়েছে। আমাদের সব সোর্সকে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাচ্চাটিকে আমরা জীবিত উদ্ধার করতে পারিনি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, একজনই প্রত্যক্ষভাবে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
লালমোহননিউজ/ -এইচপি